প্রশ্ন হলো : বাংলাশিক্ষাটি উঠে যাবে কিনা! এর সহজ উত্তর হলো : যতদিন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হবে ততদিন বাংলাশিক্ষা উঠে যাবে না। কারণ, ছাত্রছাত্রীদের সবগুলো বিষয়ে এ প্লাস পাওয়ার প্রয়োজনে বাংলাশিক্ষাটি থাকছে; যেমন আছে এখন। ব্যাপারটি আর কিছু নয় : নম্বরের প্রয়োজনে আজ বাংলাশিক্ষা হয়। বুয়েট বা এ-রকম কিছু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে দিয়েছে, সবগুলো বিষয়ে এ প্লাস না পেলে ভর্তি পরীক্ষায় দরখাস্তই করা যাবে না। এ-রকম বাধ্যবাধকতা থাকায় ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে বাংলার শিক্ষকদের গৃহমুখী হচ্ছে অথবা নানা কোচিয়ে নাম লেখাচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য বাংলায় এ প্লাস পাওয়া : বাংলাশিক্ষা নয়।
বাংলাশিক্ষাটি বরাবরই অবহেলিত ছিল। আর ‘বাংলা’ কথাটিও সম্ভ্রমার্থে খুব কম ব্যবহার হয়েছে। যেমন, ‘বাংলা পাঁচের মতো’ মুখ কথাটি প্রচলিত থাকলেও পেটুক বা স্ফীতোদরকে ‘ইংরেজি ডি-এর মতো’ পেট কথাটি কেউ বলে না। বাংলা পাঁচ শ্লেষ বা কৌতুকজ্ঞাপক কিন্তু ইংরেজি ডি তা নয়। কেন? এর কোনো উত্তর নেই। ‘বাংলা সাবান’, ‘বাংলা মদ’, ‘বাংলা কলা’ ইত্যাদি শব্দ গুণগত ‘উচ্চমান নয়’ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। ফলে বাংলা শব্দটি সাধারণ বাঙালিজনের কাছে গুরুত্ব নিয়ে আসেনি। ভাষা হিসাবেও ক্ষমতা ও অর্থনীতি থেকে এটি সবসময় দূরে থেকেছে। সংস্কৃতের দাপটের সময় ব্রাত্যজনের ভাষা হিসাবে প্রাকৃত বা তারপর বাংলা অনেকটা অবহেলিত ছিল। এরপর মুসলিম জামানায় ফারসি যখন রাজভাষা হিসাবে মর্যাদা পেল এবং ক্ষমতা ও অর্থনীতির ভাষা হয়ে উঠল, তখনো বাংলা অনাদরেই রাজপ্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। শতকরা দুভাগ মানুষেরও মুখের ভাষা ছিল না ফারসি। কিন্তু শুধু রাজভাষা হওয়ার কারণে সংস্কৃতজানা মানুষেরাও ছেলেপুলেকে পণ্ডিত রেখে সংস্কৃত ভাষা না-শিখিয়ে মৌলবি রেখে ফারসি শিখিয়েছেন। ব্রাহ্মণ থেকে ব্রাহ্ম হওয়া রামমোহন রায় ফারসি ভাষাবিদ হলেন।
মুসলিম জামানার শেষে ইংরেজকাল শুরু হলেও ফারসি রাজভাষা ছিল বলেই রামমোহন ভাষাটি শিখেছিলেন। ফারসি ভাষাতে তার ব্যুৎপত্তি এতটাই ছিল : ‘মিরাতউল আখবার’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করার ভার তিনি নিয়েছিলেন। রামমোহন ছাড়াও সে-সময় অনেকে ফারসি ভাষা শিখেছিলেন। কারণ, ফারসি জানলে আয়রোজগার বেশি হবে, প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে। কিন্তু সময় দ্রুত পাল্টে যায় আর ফারসির জায়গা নেয় ইংরেজি। ভারতীয়দের এবার ইংরেজি শেখার পালা। বাঙালিরাও সে দৌড়ে অগ্রগামী ছিল। আবার ইংরেজরাও অন্য ভাষা শেখার জন্য এগিয়ে আসে। এটা ক্ষমতার জন্য; ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে। তারা আরবি, ফারসি, হিন্দুস্থানি, সংস্কৃত আর বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করে। এখানেও কিন্তু বাংলাটি শেষে। এর কারণ হলো, বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষা আর অন্যগুলো সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। ইংরেজরা ইংরেজিকে ক্ষমতা ও অর্থনীতির ভাষা করে তোলে খুবই তাড়াতাড়ি। আর বাঙালিও ফারসির বদলে ইংরেজি শেখা আরম্ভ করে। ১৮৩৫ সালে ফারসির বদলে ইংরেজি সরকারি কাজে স্বীকৃত ভাষা হিসাবে গৃহীত হলে বাঙালির মুখে খুব দ্রুতই ইংরেজি বোল ফোটে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার একটি কবিতায় খানিকটা ব্যঙ্গ করে লিখেছেন : ‘যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে/ কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/ তখন এ বি শিখে/ বিবি সেজে/ বিলাতী বোল কবেই কবে।’ শুধু কি নারী? ছেলেদেরও একই অবস্থা। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন : ‘যত কালের যুবো যেন সুবো/ ইংরেজি কয় বাঁকা ভাবে।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আরও ব্যাপার আছে। যেমন : ‘সব কাঁটা চামচে ধোরবে শেষে/ পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে?’ এভাবে বাংলায় রাতারাতি ইংরেজি ভাষার প্রসার ঘটে এবং ক্ষমতা ও অর্থনীতির সঙ্গে ভাষাটি যুক্ত হয়। বাংলা ব্রাত্য ভাষা হিসাবেই থেকে যায় ইংরেজ রাজত্বে। তাই বাংলাভাষা সেভাবে শেখার দরকার হয় না, যেভাবে একসময় ফারসি বা পরে ইংরেজি শেখে বাঙালিরা। তবু কতিপয় বাংলাপ্রাণ মানুষ এই ভাষাচর্চা ও প্রসারে কাজ করে যান এবং তারা কাজটি করে যান কোনো কিছুর আশা না করে : না অর্থ, না ক্ষমতা! এর পেছনে থাকে শুধু ভালোবাসা।
নাটক-সিনেমায় ‘বাংলার মাস্টারমশাই’ বা ‘বাংলার স্যার’ বলে একটি চিত্র আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরা হয়। তাদেরও প্রায়ই ব্যঙ্গ বা হাস্যকর করে তুলে আনতে দেখি। বাংলার শিক্ষক মানেই যেন ঢিলেঢালা পোশাক, অসংলগ্ন ও হাস্যকর কথা, ভুঁড়িওয়ালা তুলতুলে দেহ ইত্যাদি। অথচ বাংলাশিক্ষকদের সবার কিন্তু সে-রকম দেহ আর চলন ছিল না। অনেকেই দারিদ্র্যে থাকতেন, ছিন্নবস্ত্রও ছিল অনেকের, শরীরও শীর্ণতায় আক্রান্ত থাকত। সেসব নাটক বা সিনেমায় বাংলাশিক্ষকদের যেভাবে চিত্রিত করা হয় সে তুলনায় ইংরেজি বা গণিতের শিক্ষকদের দেখা যায় না। এর কারণ কী? এর কারণ হয়তো বাংলা শিক্ষকদের অনেকটা সরল ও আটপৌরেভাবে শিক্ষাদান। হ্যাঁ, বাংলাশিক্ষকরা সেভাবেই পড়াতেন। এর কারণ আছে। কারণটি হলো, শিক্ষাদানের গুরুশিষ্য পরম্পরা ধারাটি তারা বহন করেছিলেন অনেক দিন অবধি। বৃক্ষতল বা টোল-পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ধারায় আদ্য-মধ্য-উপাধি পরীক্ষা যেভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিল শিষ্যরা, বাংলাশিক্ষকরাও সেভাবেই তাদের ছাত্রদের শেখানোর ভার নিয়েছিলেন। ইংরেজদের স্টাইলে পঞ্চাশ মিনিটের শ্রেণিঘণ্টা বা টেবিল-বেঞ্চের শিক্ষা পদ্ধতি তারা নেননি। শেখানোটাই ছিল তাদের কাছে মুখ্য, পরীক্ষা তাই শিক্ষার্থীদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা করে তোলেননি কখনো। বাংলাশিক্ষকরা অনেক মায়াময় ছিলেন এবং তাদের পাঠদানের ক্ষেত্রে পোশাকি ভাবটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি। আর একটি বড় কথা, বাংলাশিক্ষককে শিক্ষার্থীরা ভয় করত, এমন কথা শোনা যায় না। ইংরেজি বা গণিত শিক্ষকদের সম্পর্কে প্রায়শ যে-কথা শোনা যায়, রাগ আর বেত নাকি অনেকের নামের সঙ্গে মেশানো-বাংলাশিক্ষক প্রসঙ্গে তেমন মিথ নেই বললেই চলে।
আমি আর আমার বাবার শিক্ষক শ্রদ্ধেয় প্রকাশচন্দ্র মোদক। প্রকাশ স্যারের কাছেই আমরা দুজন পড়েছি। মানে, স্যার যৌবনকালে আমার পিতার শিক্ষক ছিলেন আর শেষ-বয়সে ছিলেন আমার শিক্ষক। প্রকাশ স্যার আমাকে সবই পড়াতেন। তার স্কুলটি ছিল শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি অবধি। বাংলার প্রতি ভালোবাসা আমার সেই তখন থেকে শুরু। সেই যে অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত মুখস্থ করেছিলাম, বর্ণ লেখা শিখেছিলাম, বর্ণের মাত্রাজ্ঞান রপ্ত করেছিলাম- আজ বুঝি, সেটি প্রকাশ স্যারের কৃতিত্বে। পরে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম পর্যন্ত স্কুলে নিজের পিতাকেই পেয়েছিলাম বাংলাশিক্ষক হিসাবে। তার কাছে শিখেছি বাংলা পাঠ আর ব্যাকরণ। আমার উচ্চারণ সচেতনতার প্রথম শিক্ষক আমার পিতা। তবে সেটা ঘরে নয়, স্কুলেই। বাবার কাছে বেশি নম্বর পাওয়ায় বন্ধুরা এটা-ওটা বলত, জ্বালাতও। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বাংলায় ভর্তি হলাম আর পরে ভালো ফল করে হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখন বন্ধুরা বুঝেছিল, সেদিন আমার পিতা আমি পুত্র বলে বেশি নম্বর দিয়ে দেননি, ওটা আমি অর্জন করেই নিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলজীবনে আরও কয়েকজনের কাছে বাংলা পাঠ আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কেউ ঘণ্টা মেপে পড়াননি। কলেজজীবনে বয়েজ কলেজে ভর্তি হই আর আবু তাহের স্যারের কাছে বাংলা পড়েছিলাম। মহিলা কলেজে বাংলা পড়াতেন গঙ্গেশচন্দ্র দে স্যার। বাংলার স্যারদের কথা শ্রেণিকক্ষের বাইরেও অনেক শুনেছি। যেমন, গঙ্গেশচন্দ্র স্যার মহিলা কলেজের শিক্ষক ছিলেন কিন্তু তাকে আমিও শিক্ষক মানি। কারণ, শিক্ষা তার কাছ থেকে নিয়েছি। আমি যে শহরে স্কুল আর কলেজে পড়েছি সেই শহরে সাহিত্য আড্ডা, নানা সম্মেলন, প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত আর এ স্যারদের কেউ-না-কেউ এগুলোতে অতিথি হিসাবে বক্তব্য দিতেন। বাংলা কীভাবে বলতে হয়, উপস্থাপন করতে হয়- পাঠটুকু তাদের কাছ থেকেও নিয়েছি। আমার আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বাংলা শেখাটা যেন আনন্দ আর আকর্ষণের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। আর এর মধ্যে প্রায়ই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া- সেটি ছিল বাড়তি যোগ। স্কুলে, এমন কি কলেজেও বাংলা যারা পড়াতেন তারা হাতের লেখা থেকে শুরু করে বানান, শব্দ গঠন আর উপস্থাপনা সবই গুরুত্ব দিয়ে শেখাতেন। আমার মনে আছে, শিক্ষক-পিতার কাছে শ্রেণিকক্ষেই প্রথম শিখেছিলাম ‘নেই’ আর ‘নিই’-এর পার্থক্য। ‘আমি একটি কলম নেই’ নাকি ‘আমি একটি কলম নিই’? ‘আই টুক এ পেন’ বললে এর বাংলা দ্বিতীয়টি হবে।
‘নেই’ আর ‘নিই’-এর মধ্যে অর্থগত বিস্তর ফারাক। আজ বাংলা শেখানোতে এ পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হয় না বোধহয়। এখন স্কুলে জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগমূলক আর উচ্চতর দক্ষতা-এ চার ভাগে ভাগ করে উত্তর লেখার কাঠামো বাতলে দেওয়া আছে। কবিতা মুখস্থ করাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। বলা হয়েছে, জ্ঞানমূলকে জ্ঞান থাকলেই নম্বর দিতে হবে। আবার অর্ধনম্বর দেওয়াও যাবে না। তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা কে? এ প্রশ্নের উত্তরে যদি কেউ লেখে ‘ড়বিন্দ্রনাত টাকুড়’ তাহলেও শিক্ষক তাকে পূর্ণ নম্বর দিতে বাধ্য হবেন। কারণ, ছাত্রটির জ্ঞান আছে এবং সে উত্তরটি জানে। কিন্তু এটা কি জানা হলো?
জানা মানে কি প্রকাশ করতে না পারা বা ভুল ভাবে প্রকাশ করা? আমাদের সময় বাংলায় সবচেয়ে কম নম্বর আসত। কারণ, ভুল বানান বা শব্দ-বাক্য হলে নম্বর উঠত না। বাংলায় কেউ শতকরা ষাট নম্বর পেলে তো হৈ-হৈ আনন্দ হতো। আজ এ প্লাসের যুগে আশির নিচে পেলে চলে না। কিন্তু এ প্লাস পাওয়া অনেকেই চিঠির প্রাপক আর প্রেরক বলতে কী বোঝায় এবং শব্দ দুটোর কোনটি চিঠির ডান-বামের কোথায় লিখতে হয় তা জানে না; জানে না ঠিকভাবে একটি সারমর্ম লিখতেও। গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে বাংলায় শতকরা পঞ্চান্ন পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রীর বাংলাজ্ঞানও আজ বিস্ময় জাগায়। কেন? এখন তো মুহূর্ত ধরে ধরে ক্লাস হয়, ছাত্ররা বাংলা প্রাইভেট পড়ার জন্য কোচিং সেন্টারে ছোটে আর আগে তো এমনটি হয়নি : তারপরও কেন একালে বাংলা পড়াটি প্রার্থিত ফল আনতে পারেনি?
আমি ঢাকা কলেজের অনেক ছাত্রের কাছে শুনেছি : শওকত ওসমান বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কোনো বছর সিলেবাস সম্পূর্ণ করেননি। কিন্তু তারা ক্লাসে ঢুকলে ছাত্ররা আর বের হতে চাইত না। তারা বইয়ের বাইরে অনেক কথা বলতেন এবং সেগুলো কোনোদিন বার্ষিক পরীক্ষায় আসত না। বার্ষিক পরীক্ষায় আসতনা বটে, সেগুলো আসত জীবন-পরীক্ষায়। আর আজ স্কুল বা কলেজের পড়া বার্ষিক পরীক্ষায় আসে কিন্তু তা জীবনে কোনো কাজে লাগে না। আমি আমার জীবনের অনেক পাঠ অধ্যাপক হায়াৎ মামুদের কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি শ্রেণিকক্ষের চেয়ে গাছের নিচে, অফিসকক্ষে, করিডোরে দাঁড়িয়ে আমাকে অনেক বেশি শিখিয়েছেন।
শুধু আমাকে কেন, অনেককেই শিখিয়েছেন। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কাছে শিখেছি কী করে অল্পকথায় লিখতে হয়। সব লেখা যে দীর্ঘ করতে নেই, অনেক সময় অল্পকথাই রচনার ভরকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা তিনি জানিয়েছেন। মুহম্মদ ফারুক স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তার মতো রবীন্দ্রপ্রেমী খুব কম দেখেছি। এরপর অধ্যাপক ক্ষেত্র গুপ্ত, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার, অজিতকুমার ঘোষ প্রমুখের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সহকর্মী কিন্তু শিক্ষকের মতোই স্নেহ পেয়েছি আলাউদ্দিন আল আজাদ, দিলওয়ার হোসেন, মনিরুজ্জানের। সহকর্মীর কথা যখন এলোই তখন আনিসুজ্জানের কথা বলতেই হয়। তিনি আমার শ্রেণিশিক্ষক ছিলেন না কিন্তু আমাকে শিখিয়েছেন কী করে ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি লেখা যায়। বাংলাতে প্রগলভতা প্রকাশের ব্যাপারটি বেশি থাকে। আনিসুজ্জামান এ থেকে ছিলেন মুক্ত। তার প্রতিটি লেখাই যেন অনিবার্য শব্দগুচ্ছ আর তথ্যের বিশ্বস্ত উপস্থাপনা।
আমার গবেষণাগ্রন্থাবলি ছাড়াও একটি ছাত্রপাঠ্য বই আছে, যার নাম ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা’। এ বইটির জন্য অনেকেই আমার সমালোচনা করেন। তারা বলেন, আমি কেন এমন ছাত্রপাঠ্য বই লিখলাম! এ বইটি সারা দেশের চাকরিপ্রার্থী ছাত্রছাত্রীরা পড়ে থাকে। আমি বলি : এ লেখার অনুপ্রেরণা আমাকে দিয়েছেন অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষেত্র গুপ্ত, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এ মহাত্মা অধ্যাপকরা আট খণ্ডে চার হাজার পৃষ্ঠার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখেন আবার একশ বারো পৃষ্ঠায় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্যও সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ লেখেন। তারা মনে করেন, যাদের জন্য যেভাবে পরিবেশন করা দরকার তারা সেভাবেই সাহিত্যের ইতিহাস পরিবেশন করেছেন। এতে কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও যেমন বাংলা সাহিত্যে ঠিক ইতিহাসটি জানছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও তেমনি বিস্তারিতভাবে পাচ্ছে সাহিত্যের ইতিহাস। মোটকথা, টার্গেট গ্রুপ অনুসারে উপস্থাপন করাতেই বাংলাবিদ্যার ঘটবে বিস্তার। আমিও দেখেছি, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা’ বইটি দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের মনে বাংলাজ্ঞান বৃদ্ধি করা গেছে।
আদতে, বাংলাপাঠ বা বাংলাবিদ্যার প্রসার করতে হলে যান্ত্রিকভাবে এর পাঠদান থেকে বিরত থাকতে হবে। আগে ভালোবেসে সময় নিয়ে শিক্ষকরা বাংলা পড়াতেন। তারা হয়তো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস সব সময় শেষ করতে পারতেন না কিন্তু জীবনের সিলেবাসে তাদের পড়ানো বাংলাবিদ্যা খুব কাজে লাগত। আজ হয়তো এর উল্টোটাই সত্যি!