কোভিডকালের হযবরল বইমেলার পর এ বছর সত্যিকার অর্থেই স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবার মেলায় সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো
এ বছর বই বিক্রি নিয়ে প্রকাশকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘যে বিক্রির হিসাব দেওয়া হয় তার চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ টাকার বই বেশি বিক্রি হয়েছে।’
এদিকে নানা মহল থেকে বইমেলা নিয়ে নতুন করে ভাবার তাগিদ এসেছে। সারা বছর পরিকল্পনা করে আগামীতে আরও সুশৃঙ্খল বইমেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। মৌসুমি প্রকাশক ও মানসম্পন্ন বই মেলায় নিয়ে আসেন না এমন প্রকাশকদের অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর হওয়ার পরামর্শও এসেছে।
এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া বিক্রির তথ্যের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমির হিসাব অনুযায়ী মোট ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। করোনাকালে ২০২১ সালের মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি, ২০২০ সালে সাড়ে ৮২ কোটি, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি, ২০১৮ সালে ৭০ কোটি, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ২০১৬ সালে ৪২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বুধবার তার ফেসবুক পোস্টে বইমেলা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণে লেখেন, এবারের বইমেলা প্রকাশকদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। তবুও যে নির্বিঘ্নে বইমেলা শেষ হয়েছে এজন্য মনে প্রশান্তি বোধ হচ্ছে। আমার পর্যবেক্ষণে এবারের বইমেলার কিছু ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ ঝড়-বৃষ্টি মেলার ক্ষতি করেনি।
কর্তৃপক্ষ ও প্রকৃতির দয়ায় প্রচুর ধুলাবালি ছিল। প্রতি বিকাল ধুলাময় মেলায় পরিণত হয়েছে। কাগজের উচ্চমূল্য ও দুঃষ্প্রাপ্যতা বই প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
প্রকাশকরা উদ্যম নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন। করোনার ২০২১ সাল বাদ দিলে সব মেলার রেকর্ড ভঙ্গ করে সবচেয়ে কম বই বিক্রি হয়েছে। মেলার ঐতিহ্য ভঙ্গ করে শেষ দিন যে কোনো বছরের বইমেলার শেষ দিনের চেয়ে অনেক কম বই বিক্রি হয়েছে। এমনকি এ বছরের বইমেলার যে কোনো ছুটির দিনের তুলনায়ও কম বই বিক্রি হয়েছে।
এবারের মেলায় বই বিক্রি মূলত ছুটির দিনকেন্দ্রিক ছিল। পরিচিত পাঠকপ্রিয় লেখক নয় বরং ফেসবুক লেখকদের শোডাউন মেলায় প্রাধান্য পেয়েছে। বইয়ের চেয়ে ফুলের রিংয়ের চাহিদা বেশি ছিল। ছেলেমেয়েরা বই হাতে ছবি তুলে স্বস্থানে বই রেখে চলে গেছে। ইত্যাদি কোটায় ১০ নম্বর রাখলাম। আর লিখতে ভালো লাগছে না।
কিন্তু অনেক প্রকাশক বলেছেন, এবারের বইমেলা ছিল চ্যালেঞ্জের। ঐতিহ্য’র প্রকাশক আরিফুর রহমান নাঈম বলেন, আগেই বলেছি এবার যারা ঝুঁকি নিয়ে বইমেলায় মানসম্পন্ন নতুন বই প্রকাশ করবে তাদের বিক্রি ভালো হবে। মেলায় আমাদের বই বিক্রি ভালো ছিল।
মেলায় শেষদিন প্রথমার প্যাভিলিয়নে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘বেশ আশা নিয়ে শুরু হলেও মেলার শেষটায় বিক্রি আশানুরূপ ছিল না। স্টল বিন্যাসের ক্ষেত্রে স্থপতির পরামর্শ ছাড়া কাজটি করা ঠিক হয়েছে বলে মনে হয়নি। বইমেলায় মৌসুমি প্রকাশকদের বাদ দিয়ে যারা ভালো ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করেন তাদের নিয়ে গোছানো মেলা করা উচিত। এজন্য পরিকল্পনা করতে হবে বছরজুড়ে। বইমেলায় সরকারের কোনো অর্থ সহায়তা দেওয়া হয় না বলে শুনেছি। এটা যদি সত্য হয়, তা খুবই দুঃখজনক। সরকারের এ খাতে বিনিয়োগ হওয়া উচিত। কারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।’
বইমেলায় সাফল্য ও ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘আমি ব্যর্থতার কথাই আগে বলতে চাই। যা করতে চেয়েছি তার ৫০ ভাগ করতে পেরেছি বাকি ৫০ ভাগ করতে পারিনি। এক্ষেত্রে যারা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তাদেরও সহযোগিতার অভাব পেয়েছি। মেলায় বিভিন্ন জায়গায় পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা করার কথা বারবার বলা হলেও তারা সেটা করেননি।
মেলায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আসেন। সাধারণ টয়লেটের পাশাপাশি আরও মানসম্পন্ন কিছু টয়লেট রাখার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। প্যাভিলিয়ন নির্মাণের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুরুতেই নিয়ম ভঙ্গ করেছে।
ব্যর্থতার আরকেটি জায়গা পাইরেটেড বই ও নেট বই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এক প্রকাশনা যদি আরেক প্রকশনার বই হুবহু কপি করে তাহলে আর বলার অবকাশ রাখে না। এক্ষেত্রে আসলে নৈতিকভাবে আরও উন্নত হতে হবে। আর যদি সফলতার কথা বলি তাহলে মেলার বিন্যাস ভালো হয়েছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কিছু ছাড়াই মেলা সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে।’
মৌসুমি প্রকাশকদের স্টল পাওয়ার প্রসঙ্গ টানলে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকাশকদের আমরা স্টল দিতে না চাইলে তখন নানা জায়গা থেকে ফোন আসা শুরু করে। বইয়ের বিক্রির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণামতে বিক্রির যে হিসাব আমরা দেই তার থেকে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেশি বিক্রি হয়।’ কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, ‘বইমেলার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এর মাধ্যমে প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত বই মানুষের কাছে প্রদর্শনের সুযোগ পান। লেখক-পাঠক-প্রকাশক নিয়ে একটা মিলনমেলা হয়। মেলা না হলে সেটা হতো না।’
এবারের বইমেলার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তরুণ, নবীন লেখক, কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষকদের জোরালো অবস্থান। এ বিষয়ে সেলিনা হোসেন বলেন, ‘১৯৪৭-এর পর থেকে যখন এই বাংলায় নিজস্বধারায় সাহিত্যচর্চা শুরু হয় তখন সেখানেই তরুণ লেখকরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই ধারাটিই চলে আসছে। এখনকার তরুণ-নবীন লেখকরা উঠে আসছেন। তবে তাদেরকে আরও সময় দিতে হবে পরিপক্ব হওয়ার জন্য।