বেশ অনেকদিন আগের কথা। ঘটনা পঙ্খানুপুঙ্খ মনে না থাকলেও কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতি থেকে বর্ণনা করছি। খুব সকালে মহানগর প্রভাতীতে যাত্রা করছিলাম চট্টগ্রামে অফিসের কাজে। ট্রেন ছাড়তে তখন বেশ বাকি। বেশি সকালে ঘুম থেকে উঠার কারণে ক্লান্তি লাগছিলো। নির্দিষ্ট বগিতে উঠে আমার নির্ধারিত আসনে বসে পড়লাম। মুখোমুখি দুটো আসন। জানালার পাশে। আমার হাতে একটি ছোট্ট ব্যাগ, যাতে একদিনের জামা কাপড় আর কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। সযতনে ব্যাগটি কোলের উপর রেখে চোখ বন্ধ করতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন জেগে উঠলাম দেখলাম প্রায় ঘন্টা খানেক ঘুমিয়েছি। ট্রেন মনে হয় অনেক আগেই চলতে শুরু করেছে। আমার সামনে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। গায়ের রং শ্যামলা, চোখে চশমা। ভদ্রলোক মনে হয়ে এতক্ষন আমাকেই দেখছিলেন গভীর ভাবে। আমি চোখ মেলতেই তিনি তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন আমার দিক থেকে। তাঁকে বেশ পরিচিতই মনে হচ্ছিলো। কোথায় যেন দেখেছি ? অথবা এমন চেহারার আর কাউকে হয়তো চিনি। সে যা হোক, যাত্রা পথে সাথে বই রাখি, যা পড়তে পড়তে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। এ আমার অনেক দিনের অভ্যেস।
রেলগাড়িতে ভ্রমণ আমার সবচেয়ে প্রিয়। শৈশবে যখন রেলগাড়িতে ভ্রমণ করতাম, তখন শরীরের প্রায় অর্ধেক থাকতো জানালার বাইরে। কখনো নির্মল, কখনো বা ধুলো মাখা বাতাস আমার সারা শরীরে পরশ বুলিয়ে যেত। জানালা দিয়ে খুব উপভোগ করতাম বাইরের বিস্তৃত শস্য খেত, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিল, মাঝে মধ্যে নদী -নালা, দূরে আকাশের গায়ে মিশে থাকা গাছপালা। রেলগাড়ি চলার সময় যে দুলোনি হতো সেটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো। ক্লান্ত হয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে রেলগাড়ির দুলোনি উপভোগ করতাম। দোলা খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। এখনো ভালো লাগে রেলগাড়ির দুলোনি।
বই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। কারণ সামনের লোকটি আমার দিকে চেয়ে আছে। কেমন একটি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। পড়া বন্ধ করে হঠাৎ তাঁর দিকে তাকাতেই সে আবার তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আমি ভনিতা না করে যতটুকু সম্ভব মুখের বিরক্তি দূর করে হাসি মুখে তাঁর দিকে তাকালাম। এবার তাঁর অস্বস্তির পালা। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ভাই আপনাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। ভাই কি চট্টগ্রামে থাকেন? আমি বললাম, না আমি ঢাকায় থাকি। তিনি বললেন, ঢাকা কি আপনাদের আদি বাড়ি। আমি বললাম, না আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। তিনি যেন তড়িতাহত হলেন। বলেন কি, ‘ আমার বাড়িও তো সিরাজগঞ্জ। তা আপনার বাড়ি শহরের কোন এলাকায় ? আমি বললাম আসলে আমাদের আদি বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে। তবে আমি আমার মেঝো খালার সিরাজগঞ্জের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলাম। তাদের বাড়ির নাম “চিটাগং কুঠি”। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনি কি চররায়পুর স্কুলে পড়েছেন কখনো? আমি বললাম, হা দু’ বছর পড়েছি। তিনি ফুটবলের পেনাল্টি শটের মতই নিশ্চিত ভাবেই বললেন, আমার নাম সাত্তার, এ নামে কি কাউকে চিনতেন ? এবার আমার অবাক হবার পালা, আমি আমার নাম বলা মাত্রই উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বন্ধু তোর সাথে এভাবে দেখা হবে কোনো দিন ভাবি নি। বললাম, তোর তো কোনো পরিবর্তনই হয় নি মুখের আদল অবিকল রয়ে গেছে, শুধু ছোট মুখটি আকারে বড় হয়েছে। তারপর অনেক কথা, অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প। জেনেছিলাম, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স করে সিরাজগঞ্জ এক বেসরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। তারপর সিরাজগঞ্জ বি এল কলেজে অধ্যাপনা করেছিল কিছুদিন। বর্তমানে ঢাকার এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করছে। পরীক্ষার এক্সটার্নাল হিসেবে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এখন নাকি নতুন সিরাজগঞ্জ শহর আমি চিনতেই পারবো না। ভাবলাম, যে শহরে স্মৃতি নেই বললেই চলে তাকে চেনার আগ্রহ তেমন নেই। এখন আমার একমাত্র আগ্রহ সাত্তারের জীবন কাহিনী শোনার। নিজের চেষ্টায় একজন দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে তার এমন উত্থান আমার বেশ ভালো লাগছিলো। তখন হাতে অনেক সময় প্রায় পাঁচ ঘন্টা লাগবে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে। আমি বললাম, তোর সংসারের কথা বল। সে বললো, বিয়ে করেছি প্রায় সাত বছর হয়ে গেলো। আমার একটি মাত্র মেয়ে নিয়ে আমরা ভালোই আছি। তারপর বললো , একটু বস আমি বাথরুম থেকে আসছি। আমি ফিরে গেলাম আমার শৈশবে, সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় সিরাজগঞ্জের চররায়পুর স্কুলে। সাত্তার গ্রামের অতি সহজ সরল একজন মানুষ। সিরাজগঞ্জ চর রায়পুর স্কুলে আমার সহপাঠীদের মধ্যে যে বন্ধুরা স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পেরেছিলো তাদের মধ্যে সাত্তার অন্যতম। সে সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়ালেখা করতো, তাদের হিসাব জ্ঞান হলেই তাদের অভিভাবক লেখাপড়া বন্ধ করে তাদের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দিতেন। সাত্তার উৎরাতে পেরেছিলো কারণ তার বড়ভাই লেখাপড়া শেষ করে স্থানীয় কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন যা সাত্তারকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো।
প্রতিটি মানুষের বন্ধুত্বের পেছনে রাসায়নিক বন্ধন থাকে। তা না হলে ঠিক বন্ধুত্ব গাঢ় হয় না। সাত্তারের সাথে আমার রাসায়নিক বন্ধন হয়েছিল। আমরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তখন তার বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। ওই বয়সে বিশবিদ্যালয় না বুঝলেও বুঝতাম অনেক উঁচু ক্লাসে পড়েন। ওরা নিম্ন বিত্ত পরিবারের। সাত্তারের সাথে আমার বন্ধুত্বের কাল মাত্র দু’ বছর। তারপর আমরা পাবনা চলে যাই। এরপর আর সিরাজগঞ্জ শহরে যাওয়া হয় নি। কারণ সে সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে, পাবনার নগরবাড়ী ঘাট থেকে লঞ্চে সোজা আমাদের গ্রামে যেতাম।
সাত্তার ফিরে এসে তার আসনে বসলো। কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে খাঁটি সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে। বললো, বন্দু, আমগোরে ডাকার বাসায় তোমার কিন্তু আসাই নাগবো নে। আবার কইলাম একলা আইসো না, পরিবার হাতে কইরা নিয়া আসপা, বুজছাও। আমি বললাম, অবশ্যই যামু। আমি আবার শৈশবে ফিরে গেলাম। ছেলেবেলায় আমার জীবনে একবারই সাত্তারের বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন স্কুল কি কারণে যেন ছুটি হয়েছিল, মনে পড়ছে না। দুই বন্ধু হাটছি , হঠাৎ সে বলে বসলো, নও আমগোরে বাড়িত যাই। আমিও কি মনে করে ওর সাথে রওনা হলাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে, দেখি একটি ছোট ছেলে, চোখ বন্ধ করে একটি লাঠি ঘোরাচ্ছে আর বলছে, আন্দিকুন্দি ভাই, কারো যদি বাড়ি নাগে আমার দোষ নাই। আমি বিপদ দেখতে পেলাম। এটুকু বুঝেছিলাম ওর লাঠির বাড়ি আমার দেহে পড়লে তার জন্য সে দায়ী হবে না। মারাত্মক ঝুঁকি। এ ঝুঁকির মধ্যে না যাওয়াই ভালো তাই আর দেরি না করে এক দৌড়ে আমাদের বাড়িতে এসে বাঁচলাম। পরে জেনেছিলাম সে সাত্তারের ছোট ভাই, ভারী দুষ্ট ছিলো। আমি অতীত স্মৃতির কথা তাকে বললাম। সে হেসেই খুন। সে বললো, সে কথা তোমার মনে আছে ? আমি বললাম থাকবে না আবার, লাঠির বাড়ি বলে কথা। তারপর বললাম, এবার নিশ্চিন্তে তোমার বাড়ি যাওয়া যায়,কারণ তোমার ছেলে সন্তান নেই। দুজনেই প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম। আমি ওর ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম, সে বললো না মানুষ হয় নাই, কোনো মতে এস এস সি পর্যন্ত পড়েছিল। আমরা তাকে মিডল ইস্ট পাঠিয়ে দেই। ওখানে বেশ ভালোই করেছে, বিয়ে করেছে আমার আগেই। এখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখেই আছে ওখানে। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললাম, বাদ দে, তোর কথা বল, তোর কি প্রেমের বিয়ে না কি দেখাদেখির বিয়ে ? লাজুক হেসে বললো, কহন যে ছাত্রীর প্রেমে পইড়া গেলাম তা কি কওয়া পারি ?তারপর আমার বাবা মাকে জানাইল্যাম, বিয়া কইরা একবারে বউ দ্যাশে নিয়ে আসমু। আমি বললাম, কেন তোর বাবা মাকে তোর সাথে রাখিস না কেন ? সে বললো, তাদের বার্ধক্য এমন পর্যায়ে গ্যাছে যে তাগো নড়াচড়ার উপায় নাই। সব কিছু চিন্তা কইরা দ্যাহাসনার লোক রাইহা দিসি। বললাম, তোর বড় ভাই ? সে বললো, তিনি পি এইচ ডি করতে সেই যে লন্ডন গেলেন আর দেশে ফিরলেন না। তবে বাবা মার জন্য প্রতি মাসে অনেক টাকা পাঠায় আমার মাধ্যমে। বললাম, তারপর? সে বললো, তারপর আবার কি ? আমি বললাম, গাছে উঠলো, পড়লো আর মরলো এমন গল্প শুনতে চাই না। ঝেড়ে কাশ। সে তার প্রথম প্রেম আর দ্বিতীয় প্রেম ও পরিণয়ের সব কথাই সুন্দর বর্ণনা করলো। সাত্তার খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এক পর্যায়ে সে বললো, বন্ধু তোমার সাথে শুদ্ধ ভাষা বলতে ভালো লাগছে না। সিরাগঞ্জের লোকের হাতে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা মানে আঞ্চলিক ভাষাকে অপমান করা। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নাই। তারপরও আঞ্চলিক ভাষার সাথে মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষা ওর অজান্তেই বেরিয়ে আসছিলো। তার সুন্দর সাবলীল বর্ণনায় আমি মুগ্ধ। আর কলেজের তরুণী প্রেমে পড়বে না তা কি হয় ! তার দুটি প্রেম কাহিনী গল্প-উপন্যাসের মত। আমি তার বলার মত করে লিখতে পারলাম না। ওর বলার মত লিখতে পারলে বেশ ভালো হতো।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার প্রেম এসেছিলো নীরবে, কারণ সে প্রেম ছিল এক তরফা। সে প্রেম নিভৃতে নির্জনে গুমরে গুমরে কেঁদে শুধুই সাত্তারের হৃদয় জ্বালা বাড়িয়েছে এর বেশি কিছু না। তাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল কিন্তু সাত্তার তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় নি। সদা ভয়, সদা লাজ , কি জানি সে কি মনে করে। সাত্তারকে আবার বাজে ছেলে ভেবে না বসে। হয়তো ভাবতে পারে প্রেম করে তো বখাটে ছেলেরা। বেশ কিছুদিন পর তারই এক সহপাঠী সবার সামনে সে মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। মেয়েটি রেগে চলে গিয়েছিলো। সাত্তার তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তার নিজের মনে ভালোবাসার ফল্গুধারার স্রোতস্বিনী নদীর বেগে বয়ে গিয়েছিলো। আবেগ উচ্ছাসে সে রাত ঘুমাতেই পারে নি। পরদিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মের ছুর্টির বন্ধ তাই সে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলো। ছুটি শেষে এসে যা দেখলো সে ধকল সাইবার মতো না। মেয়েটি সেই ছেলেটিকে নিয়ে সাত্তারের সাথে পরিচয় করে দিয়ে, বললো, ওকে তো জানিস সাহসী ছেলে। আমাকে কোনো ভনিতা না করে তোদের সবার সামনে আমাকে ভালোবাসার কথা বললো। অনেক ভেবে চিনতে মন স্থির করে ফেললাম ওর সাথেই বাকি জীবন কাটাবো। ওর কথা শুনে সাত্তারের হৃদযন্ত্র বন্ধ হবার উপক্রম। বলে কি! প্রেমের প্রস্তাব শুনে যে মেয়ে রেগে চলে গেলো সে কি না শেষ পর্যন্ত তাকেই বেছে নিলো ? তারপর অনেকদিন সে স্বাভাবিক হতে পারে নি। তার মনে একটি ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তারপর মেয়েদের এড়িয়ে চলেছে বাকি জীবন।
তারপর দ্বিতীয় প্রেমের কথা। সাত্তার তখন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক। সে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বই পড়তে দিতো। একদিন একটি বইয়ের মধ্যে তাকে উদ্দেশ্য করে একটি প্রেম পত্র পেলো, চিঠির শেষে কোনো নাম নেই, তাই বুঝতে পারছিলো না কে লিখেছে। অনেকদিন পর মেয়েটি নিজেই ধরা দিলো। সাত্তার খুবই অবাক! এ যে এমন ধারাবাহিক প্রেম-পত্র লিখতে পারে তা কখনোই ভাবতে পারে নি। এবার সে ভুল করলো না। লোক চক্ষুর অন্তরালে তাকে ভালোবাসার কথা জানালো। শিক্ষক ছাত্রীর প্রেমের কথা জানাজানি হলে সর্বনাশ। তাই তারা গোপনে প্রেম পত্রের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের প্রেমের রাজ্যে স্বর্গের বাগান রচনা করলো। অবশেষে পরিবারে প্রস্তাব পাঠালো। আমি বললাম, বাহ্ বেশ ভালো তো ! তোদের প্রেম কাহিনী খুবই মজার। সে বললো তবে একটি ক্ষুদ্র সমস্যা হয়েছিলো বন্ধু। আমি বললাম, সে আবার কি? সাত্তার বললো, বুঝলি সবই কপাল। আমি বললাম, বল না কি সমস্যা। সে বললো, আমার বিয়ের উত্তেজনা সারা কলেজে ছড়িয়ে পড়লো। আমার তখন আর্থিক সঙ্গতি ছিল এমন যে কোনোমতে বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে আসা। এতো লোক খাওয়ানের তো আমার সামর্থ্য ছিল না। তবে আমার শশুর মশায় সব ব্যবস্থা করে ধুমধামের সাথে বিয়ের দিয়েছিলেন। এমন সুন্দর আনন্দের সময় একটি ভুল করে ফেললাম। আমি বললাম, কি ভুল করলি, প্রেম পরিণয় সবই তো ঠিক !
কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, আমরা সব সময় শুনে আসছি বিয়ের রাতে বিড়াল মারার কথা। এই জঘন্য চিন্তা মানুষের মনে কি ভাবে আসে বুঝলাম না। প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ থেকে অদ্যাবধি চলে আসছে কি ভাবে গৃহস্বামী স্ত্রীকে নিজের হুকুমের দাস বানাবে। স্ত্রীকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী, বন্ধু বা জীবনসঙ্গী না ভেবে অধীনস্ত কর্মচারী ভাবার উদাহরণ অনেক আছে। অনেকে অহংকার করে বলে, আমার ভাইয়ের মারাত্মক পার্সোনালিটি, আমাদের ভাবীকে সবসময় চোখের ইশারায় রাখে। কেউ কিন্তু একবার বলেন না আমার বাবার পার্সোনালিটি অনেক তিনি আমার মাকে দাপিয়ে বেড়ান। অথবা আমার বোনের স্বামী বোনকে করা শাসনে রাখেন, বাপরে তার কি পার্সোনালিটি! নিজের বেলায় ষোলো আনা। এ ব্যাপারে একটি কৌতুক মনে পরে গেলো, তোকে বলি, তুই হয়তো শুনে থাকবি তারপর বলছি, দুই মহিলা প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে খোশ গল্প করেন। একদিন প্রথম মহিলা জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা আপা আপনার ছেলে মেয়ের তো বিয়ে হলো বেশ ক’ বছর, তা তারা কেমন সংসার করছে ? দ্বিতীয় মহিলা বললেন, কি আর বলবো আপা আমার মেয়ের বর কি যে ভালো। আমার মেয়েকে কোনো কষ্টই দেয় না। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা রেডি করে মেয়েকে ঘুম থেকে ডাকে। তারপর অফিসে যায়। কোনো সময় অফিস থেকে এসে বাইরে নিয়ে যায় আবার মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়ায়। বুঝলেন আপা মেয়েটির বিয়ে খুব ভালো হয়েছে। প্রথম মহিলা বললেন, আর আপনার ছেলে ? দ্বিতীয় মহিলা এবার নাক ফুলিয়ে, রেগে বললেন, আমার ছেলের বউ খুবই অলস, কোনো কাজই করে না, আমার ছেলেকে দিয়ে রোজ নাস্তা বানায়, অফিস থেকে আসলে বাইরে নিয়ে যায় খেতে। বাসার সব কাজই আমার ছেলে করে। ছেলের বউ বড়ই বজ্জাত, আমার ছেলেকে খাটিয়ে মারছে।
তারপর বললো, বিয়ের রাতে বিড়াল মারার নানা ধরণের গল্প আছে। এমনকি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কমেডি ” টেইমিং অফ দা শ্রু’র ” বাংলায় রূপান্তর করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মনির চৌধুরী “মুখরা রমণী বশীকরণ” নামে। কি ভাবে তার বউকে বশ করে তা তো নিশ্চয়ই পড়েছিস। তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি প্রচার হয়েছিল। যাহোক, আমার মনে পড়ে আমি যখন বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সে সময় আমার অগ্রজদের কাছ থেকে নানা উপদেশ আসতে লাগলো। উপদেশ এমনই একটি জিনিস যা না চাইতেই পাওয়া। আমাকে একজন শেখালেন কি ভাবে বিয়ের রাতেই বিড়াল মেরে বউকে বশ করতে হয়। আমি বললাম, ‘বউ কি বন্য হাতি না কি ? যে তাকে খাদায় ফেলে বশে আনতে হবে’ ! তিনি হতাশ হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে পরে বুঝবে, অভিজ্ঞতার তো কোনো দাম নেই’। যে যাই বলুক বিড়াল মারার মত নিকৃষ্ট কাজ আমি করবো না। তারপর ভুলটি করে ফেলেছিলাম, আমাদের সহকারী অধ্যক্ষের উপদেশে। তিনি বললেন, রান্নাঘর থেকে বাঁচতে হলে একটি কাজ করতে হবে আপনাকে। আর তা করতে হবে বাসর রাতেই। তবে এটাকে ঠিক বিড়াল মারা বলবেন না। তার কথায় একটু আগ্রহ বাড়লো। বিড়াল মারা না অথচ বিয়ের রাতেই করতে হবে। তিনি বললেন, বৌয়ের সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে চা বানিয়ে আসর কথা বলে রান্না ঘরে যাবেন। তারপর রান্না ঘর নোংরা করে রেখে আসবেন, দেখবেন আপনাকে কখনোই আর রান্না ঘরে যেতে দিবে না। কারণ মেয়েরা রান্না ঘর অপরিষ্কার রাখতে অপছন্দ করে।
যথাসময়ে বিয়ের রাতে ঘন্টাখানেক গল্প করার পর বউকে, বললাম একটি অপেক্ষা করো চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। এতে সে প্রবল আপত্তি করলো। বললো, আপনি বসেন আমি চা করে আনছি। আমি বললাম, তুমি আজ রাতে আমার মেহমান, কাল থেকে তুমি সাংসারিক সব দায়িত্ব পালন করবে, এ শর্তে সে রাজি হলো। আমি রান্না ঘরে ঢুকে চায়ের পানি চাপিয়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক কিছু পানি ছিটিয়ে দিলাম। কাপে চা ঢালার সময় ইচ্ছে করেই কিছু চা ফেলে দিলাম। চায়ের কেতলী, চামচ, চিনি সব এলোমেলো করে রাখলাম। দু কাপ চা নিয়ে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছি, দেখি বৌ পেছনে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে কখন প্রবেশ করেছে বুঝতে পারি নি। আমাকে বললো, আপনি রান্নাঘর অপরিষ্কার করলেন কেন ? আমি অপ্রস্তুত। মনে মনে ভাবছি বিড়াল মারতে এসে কোন ঝামেলা পড়লাম। সবশেষে সে যা বললো, তা হচ্ছে, এগুলো পরিষ্কার করে আসবেন তা না হলে আজ আর বাসর ঘরে ঢুকতে হবে না। ড্রইংরুমে সোফায় বাকি রাত কাটাবেন। এখন বল বন্ধু কার বিড়াল কে মারলো।