মুরগি-ডিমের বাজারে অস্থিরতা, সরকারি পদক্ষেপ দাবি সংশ্লিষ্টদের

অর্থনীতি, ৪ মার্চ ২০২৩, 213 বার পড়া হয়েছে,

রাইট টাইমস ডেস্ক: মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি একশ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি সোনালি, লেয়ার এবং দেশি মুরগির দামও আকাশচুম্বি।

শুধু তাই না, মাসের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমের দাম বেড়েছে এক থেকে দেড় টাকা।
মুরগির ফিড ও ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়া এবং করপোরেট কোম্পানির কারসাজির কারণে পোলট্রি শিল্পে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দাম বেড়ে বাজার অস্থিতিশীল হলেও সহসাই ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামে কোনো সুখবর নেই। আসন্ন শবে বরাত ও রমজানকে কেন্দ্র করে চাহিদা আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও আতঙ্ক বিরাজ করছে প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে। অস্থিরতার কারণে কিছুটা দাম পাবার আশায় ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ব্রয়লারও বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেক খামারি।

বাজার অস্থিতিশীলতায় প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। অস্বাভাবিক দামের কারণে বাজারে মুরগি ও ডিম বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। এ রকম অস্থিরতা মধ্যে সরকারের নজরদারি জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে আলাপকালে পাইকারি ও খুচরা মুরগি ও ডিম বিক্রেতা এবং প্রান্তিক খামারিরা বাংলানিউজকে জানান, এই রকম অস্থিরতা কারণে সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে।

খুচরা ও পাইকারি মুরগি ও ডিম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত মুরগির দাম বাড়ার কারণে আমাদের বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। মুরগি ও ডিমের দাম নিয়ে গত এক মাসের প্রতিদিনই ক্রেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালে খুচরা ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। তবে ক্রেতারা এই অস্বাভাবিক দাম বাড়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

বাজারে অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ আগে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম দিয়ে তাদের আমিষের চাহিদা মিটিয়েছে। অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে এইসব ক্রেতা সাধ্যমত মুরগি ও ডিম কিনে খেতে পারছে না।

বয়লার মুরগির দাম বাড়তি থাকায় বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে বলে জানিয়েছেন শেওড়াপাড়া অলি মিয়ার টেক বাজারের মুরগি বিক্রেতা মো. রাকিব। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিনের বেঁধে দেওয়া দামেই আমরা মুরগি বিক্রি করছি। আগে যে পরিমাণ মুরগি বিক্রি করতাম এখন তা অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে।

এই মুরগি বিক্রেতা আরও বলেন, আমার তিনটি দোকানে ১১ জন লোক কাজ করছে। এক একজন কর্মচারীর বেতন ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। এই বাজারে দুটি দোকানের দৈনিক ভাড়া ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এরপর নিজের লাভের কথা চিন্তা করতে হয়।

এভাবে বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ায় দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিয়ে নিজের চলাটাই দায় হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

মুরগির পাশাপাশি ডিম বিক্রিও কমেছে বলে জানিয়েছেন মিরপুরের পাইকারি ডিম বিক্রেতা মাসুদুর রহমান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রতিদিন আমি শেওড়াপাড়া-কাজীপাড়ার মুদি দোকানগুলোতে পাইকারি ডিম বিক্রি করি। ডিমের দাম বাড়ার কারণে বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে।

মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের ব্যয় সঙ্কোচন করতে খাবারের তালিকা থেকে ডিমের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন এই ডিম বিক্রেতা।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরেও দেখা গেছে একই চিত্র। ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ব্রয়লারও বিক্রি হচ্ছে। এর আগে এই পরিমাপের ব্রয়লার খুব একটা বাজারে দেখা মিলত না। অস্বাভাবিক দামের কারণে বাজার থেকে কিছু মুনাফা লাভের আশায় এবং দাম পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে খামারিদের অনেকেই এমনটা করছেন বলে জানিয়েছেন দাউদকান্দির প্রান্তিক খামারি মো. শাহিন।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা- এটা ব্রয়লারের সর্বোচ্চ দাম। এই দাম অনেকটা অস্বাভাবিক, তাই মুনাফার জন্য তারা কম ওজনের ব্রয়লারগুলোও বিক্রি করে দিচ্ছেন। শুধু তাই না, ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই দাম পড়ে যাওয়ার আতঙ্কও আছে। উৎপাদন খরচ ১৫০ টাকা হলেও একটা সময় ১১০ টাকা কেজিতেও ব্রয়লার বিক্রি করছেন খামারিরা।

আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই অনেকে এমনটি করছেন বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে এক মাসের মধ্যে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০০ টাকা বাড়লেও কোনো লাভ করতে পারেননি খামারিরা। বরং তাদের অনেকেই ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলেও অভিযোগ জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম ১০০ টাকা বেড়েছে। আসলে এটা বৃদ্ধি না। এখন একটা সংকটময় মুহূর্ত চলছে। এই সংকটের মুহূর্তে প্রান্তিক খামারি যারা আছেন, ফিডের দাম ও ওষুধের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, উৎপাদনের খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা টিকতে না পেরে দাম বাড়িয়েছেন। কেউ কেউ খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।

সুমন হাওলাদার আরও বলেন, এই কথাগুলো আমরা আগস্ট মাস থেকেই বলে আসছি।

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যদি প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের টিকিয়ে রাখা না যায়। এর কারণ হচ্ছে, জানুয়ারি মাসে একটি বাচ্চার দাম ছিল ১০ টাকা। আজ সেটা ৬০ টাকা। এক বস্তা খাবারের দাম ছিল ২২০০ টাকা, আজকে সেটা ৩,৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, এখানে আরেকটি বিষয় আছে, বাজার এখন কর্পোরেট কোম্পানিদের দখলে। তারা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। নিজেরা উৎপাদন করছে। এই কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য এক বস্তা ফিডের দাম ২,৬০০ টাকা। যা প্রান্তিক খামারিদের জন্য ৩,৬৫০ টাকা। যার কারণে উৎপাদন খরচ বদলে দিচ্ছে বাজার পরিস্থিতি।

তিনি বলেন, এখন আপনারা যে পণ্যটি বাজারে পাচ্ছেন, সেটা হচ্ছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পণ্য। দামের কারণে আমাদের প্রান্তিক খামারিদের খামার বন্ধ হয়ে গেছে। যখন আমরা উৎপাদন করি, তখন কন্ট্রাক্ট ফার্মিং তাদের পণ্য বাজারে দাম কমিয়ে দেয়। তখন আমরা তাদের সঙ্গে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাধ্য হচ্ছি ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াতে।
এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ডিমের দাম আরও বাড়া উচিৎ উল্লেখ করে সুমন হাওলাদার বলেন, একটি ডিম উৎপাদন করতে খরচ হয় ১১ টাকা। অথচ খামারি দাম পাচ্ছে ৯ টাকা। একটি ডিমের দাম সাড়ে ১২ টাকা হলে খামারি ন্যায্য দাম পাবে। তাই ব্রয়লারের দাম কিছুটা বাড়তি হলেও ডিমের দাম আরও বাড়া উচিৎ।

তবে এক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি বা নির্ধারিত দামে ফিড ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা না হলে ডিমের সংকট দেখা দেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনি সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং আগামীতে এই শিল্পে তরুণরা উদ্যোক্তা হওয়ার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দেবেন বলে মনে করেন তারা।