
শংকর চৌধুরী খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গিরিফিুল এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের (চবি) পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণের পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। অপহৃত শিক্ষার্থীদের দ্রুত উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।
এই ঘটনার পর থেকেই যৌথবাহিনী নিরলসভাবে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্ধার অভিযানের অংশ হিসেবে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা শুক্রবার সকাল থেকে সন্দেহজনক এলাকাগুলোতে টহল দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নিরাপত্তা চৌকি (চেকপোস্ট) বসানো হয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি ও রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালীতে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের বিচারের দাবীতে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রবিবার (২০ এপ্রিল) সকাল ১১টায় খাগড়াছড়ি শহরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত গেইটের সামনে খাগড়াছড়ি আদিবাসী ছাত্র সমাজ ব্যানারে এ প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে শহরের মহাজনপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে শাপলা চত্বর হয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালত গেইটের সামনে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থী তুষন চাকমা, সুমতি বিকাশ চাকমা, মায়া চৌধুরী, রহেল চাকমা, আকাশ ত্রিপুরা ও উক্যনু মারমা বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, গত ১৫ই এপ্রিল মধ্যরাত রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার আম্রং (বড়ডলু পাড়া) এলাকায় কয়েকজন বাঙালি ছেলে এক মারমা তরুণীকে (শিক্ষার্থী) সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। ঘটনার পরদিন সকালে লোকজন ঘটনাটি জানতে পারার আগেই ধর্ষকরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
পরে ঘটনাটি জানাজানি হলে ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে কাউখালী থানায় জিডি করা হয়। কিন্তু এ ঘটনার ৪দিন পার হয়ে গেলেও অপরাধীদের গ্রেফতারে প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীরা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে তার কোন সুষ্ঠু বিচার হয়নি, বরং ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। যার কারণে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা বেড়েই চলেছে পাহাড়ে। বক্তরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি এবং রাঙ্গামাটির কাউখালীতে মারমা তরুণী (শিক্ষার্থীকে) ধর্ষণের সাথে জরিতদের ধ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের দাবী জানান।
তবে, অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীর বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা-সমর্থিত) পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছে। পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপণ ত্রিপুরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, পিসিপির চবি শাখার সদস্য রিশন চাকমাসহ তার চার বন্ধু খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছে। ঐ “শিক্ষার্থীরা সেদিন গাড়ির টিকিট না পেয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। পরদিন সকালে চট্টগ্রামে ফেরার পথে গিরিফুল এলাকায় টমটম চালকসহ তাদের অপহরণ করা হয়”।
নিপণ ত্রিপুরা অভিযোগ করেন, “ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) সরাসরি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আমরা অবিলম্বে সকল অপহৃতদের নিঃশর্তভাবে মুক্তি এবং সুস্থ অবস্থায় ফেরত দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি করছি।”
অন্যদিকে, প্রসীত খীসা সমর্থিত ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মূল এর সংগঠক অংগ্য মারমা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “কোনো একটি পক্ষ আমাদের সংগঠনকে বিতর্কিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের বিপক্ষে এবং সবসময় পাহাড়ে ঐক্যের পক্ষে কাজ করছি। এ অপহরণ ঘটনায় আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটি আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।”
আর অসহায় বোধ করে, অপহৃত শিক্ষার্থীদের একজন দিব্যি চাকমার মা ভারতী চাকমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আবেগঘন পোস্টে লিখেছেন, “খাগড়াছড়িতে আমার মেয়ে দিব্যি চাকমা তার সহপাঠী সহ বিজুতে গেলে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরার পথে খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছে। প্লিজ কারোর মায়ের বুক খালি না করে দোষ থাকলে, অন্যায় করলে উপযুক্ত শাস্তি দিন তবুও সন্তান হারানোর বেদনা যেন কারোর বুকে না লাগে। আমি হাত জোড় করছি ফিরিয়ে দিন আমাদের সন্তানদের।
অপহৃত শিক্ষার্থীরা হলেন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ডিপার্টমেন্টের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মৈত্রীময় চাকমা, নাট্যকলা বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী দিব্যি চাকমা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রিশন চাকমা, প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী লংঙি ম্রো, চারুকলা ডিপার্টমেন্টের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অলড্রিন ত্রিপুরা। ভগবান খুব কষ্ট হচ্ছে, একটার পর একটা বিপদ।”
প্রসঙ্গত, গত ১৬ এপ্রিল (বুধবার) খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, নাট্যকলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের পাঁচজন শিক্ষার্থী এবং এক ইজিবাইক চালক নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় খাগড়াছড়িতে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অপহরণের খবর পাওয়ার পরপরই তারা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে এবং অন্যান্য জোনও এই অভিযানে অংশ নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে।