সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি:
পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ ও দন্ডনীয় অপরাধ হলেও
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় রাতের অন্ধকারে বনের ভেতর পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট। সরকারি পাহাড় কেটে এসব মাটি স্থানীয় মানুষের বসতভিটা ভরাটে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড় কাটার সাথে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় মোক্তার ও আলমগীরের নেতৃত্বে বড় একটি সিন্ডিকেট। এদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে একাধিক ব্যক্তি মাটি বিক্রির সাথে জড়িত। তাই তারা বিশেষ করে সপ্তাহিক সরকারি বন্ধের রাতগুলোতে পাহাড় কাটার নিরাপদ সময় বেঁচে নেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের পদুয়া রেঞ্জের আওতাধীন উপজেলার বাজালিয়া বড়দুয়ারা ফরেস্ট বিট কাম চেক স্টেশনের ১কিলোমিটারের মধ্যে কেরানিহাট বান্দরবান সড়কের পাশেই মইন্যার টেকে বনের বাগানের মধ্যে নির্বিচারে মাটি খোঁড়ার যন্ত্র (স্কেভেটর) দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। বিট কার্যালয়ের নাকের ডগায় নিয়মিত পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে। বনবিভাগের লোকজন খবর পায় অধিকাংশ পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে গেলে। বড়দুয়ারা মইন্যার টেক এলাকায় লাগাতার এক সপ্তাহ পাহাড় কাটার পর পদুয়া রেঞ্জের কর্মকর্তার নেতৃত্বে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে দুটি ডাম্পার ট্রাক জব্দ ও ৩ জন শ্রমিককে আটক করে বন আদালতে সোপর্দ করা হয়। তবে পাহাড় কাটার সাথে জড়িত সুনির্দিষ্ট এমন কাউকে আটক করতে না পারলেও মামলা একটি দিয়ে বনবিভাগ দায় সেরেছেন। বনবিভাগের অভিযানের পরেও সেখানে নিয়মিত পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে যাচ্ছে অসাধু পাহাড় খেকোরা।
স্থানীয় লোকজন জানান, সংঘবদ্ধ চক্র মইন্যার টেক এলাকার বন বিভাগের পাহাড় থেকে প্রথমে একটি মাদারট্রি গর্জন কেটে বিক্রি করে দেয়। এরপর ওই পাহাড়ে থাকা বেশ কিছু আকাশমনি গাছ কেটে নিয়ে যায়। পরে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটা শুরু করে। রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে ডাম্পার ট্রাকযোগে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের উত্তর পাশ থেকে এমনভাবে মাটি কাটা হচ্ছে বাইরে থেকে দেখে বুঝার কোনো সুযোগ নাই। প্রতি রাতে শত শত ট্রাক মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। মাটি কাটার ফলে এখন ওই পাহাড়ে থাকা একমাত্র শতবর্ষী মাদারট্রি গর্জন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। আর অল্প মাটি কাটলেই গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে উপড়ে পড়বে গর্জন গাছটি। ফলে পাহাড় থেকে আর যাতে মাটি কাটতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড়দুয়ারা ফরেস্ট বিট কাম চেক স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের অফিস থেকে সামান্য দূরের পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না। কারণ মোক্তার, আলমগীর, নুরু ও জাহেদসহ যারা পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে তারা এলাকায় প্রভাবশালী। তারা যখন তখন যাকে তাকে কারণে–অকারণে মারধর করে। শুধু এই একটি পাহাড় নয়, মোক্তারের নেতৃত্বে গত বছর মাহালিয়া এলাকায় একটি পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। সরকারি গাছ ও পাহাড় তাদের প্রধান টার্গেট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, বনের বাগানের ভেতর রাতে নিয়মিত পাহাড় কেটে মাটি বিক্রির সাথে বিট কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। তা না হলে পাহাড় খেকোরা কিভাবে সরকারি পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে। এ এলাকায় বনের গাছ ও মাটি নিয়মিত কাটা হয়। সরকারি বনের জায়গা দখল করে নিয়মিত বিক্রি হয়।
এসব ঘটনায় কয়টি মামলা হয়? আর যারা পাহাড় কেটেছে তাঁরা অথচ বনবিভাগের দায়ের কৃত মামলার আসামিই হয়নি। তারা প্রকাশ্যে বিট কার্যালয়ের সামনে ঘুরে বেড়ান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছর শুস্ক মৌসুম শুরু হলে বড়দুয়ারা ফরেস্ট বিট কাম চেক স্টেশনের
আওতায় বিভিন্ন স্থানে
পাহাড় কাটার উৎসব শুরু হয়। এসময় একাধিক সিন্ডিকেট মাহালিয়া, চিতামুরা ও হলুদিয়া এলাকায় পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে। এসব মাটি মানুষের বসতভিটা ভরাটে ব্যবহার করে। পাহাড় কাটা এসব মাটি প্রতি ডাম্পার বিক্রি করে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২ শত টাকায়।
সরেজমিন উপজেলার বাজালিয়া বড়দুয়ারা মইন্যার টেক ঘুরে দেখা যায়, বনের বাগানের মাঝ দিয়ে অস্থায়ী সড়ক বানানো হয়েছে। সড়ক দিয়ে পাহাড়ের উত্তর পাশ থেকে দক্ষিণ মুখে মাটি কাটা হয়েছে স্কেভেটর দিয়ে।
বিভিন্ন প্রজাতির শত শত গাছ নিধন করে পাহাড়ের এক পাশ থেকে মাটি কেটে কয়েক হাজার বর্গফুট করা হয়েছে সমতল। ফলে পাহাড়কে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। প্রকৃতির বুকে মানুষের এমন থাবায় জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাজালিয়া এলাকায় যেভাবে নির্বিচারে ও অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে তা জনজীবনে হুমকি স্বরূপ। এছাড়া এসব এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সুযোগ বুঝে কিছু মানুষ বনবিভাগের জায়গা দখলসত্ব লাখ টাকায় বিক্রি করে। বনের ভিতর পাহাড় কেটে তারা বনবিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে সেখানে স্থায়ী ঘর নির্মাণ করে। পাহাড়ে যেসব বাড়িঘর রযেছে ভারী বর্ষণে যেকোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে। এতে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকাও রয়েছে।
বাজালিয়া বড়দুয়ারা ফরেস্ট বিট কাম চেক স্টেশনের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালানো হয়। পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা ২টি ট্রাকসহ ৩ জনকে আটক করে মামলা দিয়েছি।
পাহাড় কাটার সাথে কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি তাদের নাম বলতে পারবো না। কারণ তারা এলাকায় কারো কাছে প্রভাবশালী আবার কারো কাছে দুষ্টু লোক হিসেবে পরিচিত। নাম প্রকাশ করলে তারা আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।
পাহাড় কাটার ঘটনায় অভিযুক্ত উত্তর বাজালিয়ার মোক্তার আহমদ বলেন, পাহাড় কাটার সাথে আমরা জড়িত নই। আমরা মাটির ব্যবসা করি হিসেবে হয়তো আমাদের নাম বলা হচ্ছে। আমি অতীতেও কোনো দিন পাহাড় কাটার সাথে জড়িত ছিলাম না। মইন্যার টেক পাহাড় কাটার সাথে আমাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নাই।
বাজালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান তাপস কান্তি দত্ত বলেন, বাজালিয়ায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র আছে যারা সরকারি পাহাড়ের মাটি আর গাছ বিক্রি করে চলে। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। তাদের মাটি ও গাছ কাটার সময় বাধা দিতে গিয়ে ইতিপূর্বে বন বিভাগের লোকজনও লাঞ্ছিত হয়েছেন। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করবো এসব বন ও পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
পদুয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা
মো: মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, বাজালিয়া বড়দুয়ারা এলাকায় পাহাড় কাটার খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালানো হয়। আমাদের বনবিভাগের অভিযানে দুটি ডাম্পার ট্রাকসহ ৩ জনকে আটক করে বন আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। বন আদালতের বিচারক তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে। এখনো যদি পাহাড় কাটার খবর আসে আবারো অভিযান করা হবে।
বাংলাদশে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোঃ ফেরদৌস আনোয়ার জানান, পাহাড়কাটা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনে স্পষ্ট লঙ্গন। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ নষ্ট হয় এবং জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। ফলে ঘটে মারাত্মক ভূমিধস।
সাতকানিয়া বাজালিয়ায় পাহাড় কাটার বিষয়ে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। যেহেতু আপনি জানতে চেয়েছেন আমরা খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।